চিত্রনায়ক সালমান শাহর মৃত্যুর ৫ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু এটি হত্যা না আত্মহত্যা—এই বিতর্কের শেষ হয়নি আজও। সর্বশেষ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সালমান আত্মহত্যা করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে সিআইডি ও বিচার বিভাগীয় তদন্তেও উঠে আসে, সালমানকে হত্যা করা হয়নি। তবে সালমানকে হত্যা করা হয়েছে, এমন দাবি করে আসছেন তাঁর মা মামলার বাদী নীলা চৌধুরী। অবশ্য আজ রবিবার শেষবারের মতো পিবিআইয়ের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর বাদীর নারাজি দেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন আদালত। তবে নীলা চৌধুরী গতকাল শনিবার এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দেশে ফেরেননি।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, আজই কিবছ ২৫ রের সালমান শাহ হত্যা মামলার কার্যক্রম শেষ হবে? রাষ্ট্রপক্ষ মনে করছে, মামলাটির গতিপথ কোন দিকে যেতে পারে তা নির্ভর করছে আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর।

রাজধানীর ইস্কাটনের বাসা থেকে ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার (ইমন) ওরফে সালমান শাহর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তখন এ বিষয়ে অপমৃত্যুর মামলা করেন সালমানের বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী। ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে, এমন অভিযোগ এনে পরে ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই অভিযোগটি হত্যা মামলায় রূপান্তর করার আবেদন জানান তিনি।

এই অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডিকে নির্দেশ দেন আদালত। সালমান হত্যা মামলার তদন্ত শেষে ১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সিআইডি। প্রতিবেদনে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়। পরে ওই বছরের ২৫ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন গৃহীত হয়। তবে এই তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে রিভিশন মামলা করেন কমরউদ্দিন।

পরে ২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠান আদালত। দীর্ঘ ১১ বছর পর ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার সিএমএম আদালতের বিচারক বিকাশ কুমার সাহার কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক। ওই প্রতিবেদনেও সালমানের মৃত্যুকে অপমৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কমরউদ্দিনের মৃত্যুর পর মামলার বাদী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন সালমানের মা নীলা চৌধুরী। ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নীলা চৌধুরী ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজির আবেদন করেন।

এরপর পিবিআই তদন্ত করেছে। সর্বশেষ গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে ৬০০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দেন পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলা চলচ্চিত্রের তুমুল জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহ হত্যাকাণ্ডের শিকার হননি, পারিবারিক কলহের জের ধরে আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি।

প্রতিবেদন তুলে ধরে সিরাজুল ইসলাম বলেন, তদন্তকালে ঘটনার সময় উপস্থিত ও ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ৪৪ সাক্ষীর জবানবন্দি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় লিপিবদ্ধ করা হয়। ১০ সাক্ষীর সাক্ষ্য ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় লিপিবদ্ধ করা হয়। পাশাপাশি ঘটনার সংশ্লিষ্ট আলামত জব্দ করা হয়। এসব বিষয় পর্যালোচনায় দেখা যায়, সালমান পারিবারিক কলহের জের ধরে আত্মহত্যা করেছেন। হত্যার অভিযোগের কোনো প্রমাণ মেলেনি।

পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে সালমান শাহর আত্মহত্যার পাঁচটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হলো—চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে সালমানের অতিরিক্ত অন্তরঙ্গতা, স্ত্রী সামিরা হকের সঙ্গে দাম্পত্য কলহ, মাত্রাধিক আবেগপ্রবণতার কারণে একাধিকবার আত্মঘাতী হওয়া বা আত্মহত্যার চেষ্টা, মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসা জটিল সম্পর্কের বেড়াজালে পড়ে পুঞ্জীভূত অভিমানে রূপ নেওয়া এবং সন্তান না হওয়ায় দাম্পত্য জীবনে অপূর্ণতা।

এই মামলায় আসামি করা হয় আজিজ মোহাম্মদ ভাই, সামিরা হক, লতিফা হক লুসি, রেজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ, নজরুল শেখ, ডেভিড, আশরাফুল হক ডন, রাবেয়া সুলতানা রুবি, মোস্তাক ওয়াইদ, আবুল হোসেন খান ও মনোয়ারা বেগমকে।

বাদীপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মামলার বাদী নীলা চৌধুরী দেশের বাইরে এবং করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দেশে ফিরতে না পেরে পিবিআইয়ের দেওয়া চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি দিতে পারেননি। গত ৩১ আগস্ট মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি গ্রহণের জন্য ধার্য ছিল। এদিন নারাজি দেবেন বলে সময়ের আবেদন করা হয়। এরপর আদালত শেষবারের মতো সময়ের আবেদন মঞ্জুর করে ৩১ অক্টোবর (আজ) শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, নীলা চৌধুরী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকায় দেশে ফিরতে পারেননি। তবে কাল (আজ) সালমান শাহর মামা আলমগীর কুমকুম আদালতে উপস্থিত হবেন। আমরা পুনরায় নারাজির জন্য সময়ের আবেদন করব।’

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সালমান শাহ হত্যা মামলার নারাজির জন্য শেষবারের মতো দিন ধার্য আছে। সে ক্ষেত্রে বাদীকে চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি দিতে হবে। তবে বাদী নারাজি না দিলে এখতিয়ার অনুযায়ী আদালত সিদ্ধান্ত নিবেন